গ্যাস সংকটে অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে কুমিল্লার সদর দক্ষিণের বিজয়পুরে অবস্থিত ৬২ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে গ্যাস সংযোগ না থাকায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এই শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থা। এতে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনাময় এই শিল্পে নেমে এসেছে স্থবিরতা। উৎপাদন কমে যাওয়ায় চাহিদার তুলনায় রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।
এক সময় বিজয়পুরের ঐতিহ্যবাহী রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি ৪০০ জনের কর্মসংস্থান ছিল, সেখানে বর্তমানে বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতিতে কাজ করছেন মাত্র ৪৬ জন, যার মধ্যে ১৫ জন পুরুষ এবং ৩১ জন নারী শ্রমিক। দিন দিন এই সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। শ্রমিক সংকটের পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে উৎপাদন ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং গ্যাস না থাকায় সনাতন পদ্ধতিতে পোড়ানোর খরচ বহন করা অসম্ভব হয়ে উঠা।
সমবায় কর্তৃপক্ষ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে কুমিল্লার বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কাছে একাধিকবার আবেদন করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। সর্বশেষ বছর খানেক আগেও একটি আবেদন জমা দেওয়া হয়, তবে এখনও পর্যন্ত কোনো উত্তর পায়নি সমিতি।
উপজেলাভিত্তিক প্রশাসনিক পর্যায়েও জানানো হয়েছে বিষয়টি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শুধু আশ্বাস দিয়ে দায় সেরেছে বলে অভিযোগ সমিতির।
সমবায় কর্তৃপক্ষ আরো জানায়, গ্যাস না থাকায় মাটির তৈজসপত্র পোড়াতে হচ্ছে কাঠ বা লাকড়ির আগুনে। এতে খরচ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।
রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক অরুণ পাল জানান, গ্যাস দিয়ে পোড়াতে যেখানে ৫০ হাজার টাকা খরচ হতো, সেখানে এখন একই পরিমাণ পণ্য পোড়াতে খরচ হচ্ছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। এর ফলে প্রতি শিফটে প্রচুর পণ্য নষ্ট হচ্ছে এবং উৎপাদিত পণ্যের গায়ে দাগ পড়ছে। গ্যাস দিয়ে ১২০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা পাওয়া যায়, কিন্তু সনাতন পদ্ধতিতে ৪০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা পাওয়া যায় বলেই টেকসই এবং গুণগতমানসম্পন্ন পণ্য তৈরি করা যাচ্ছে না। এতে করে স্থানীয় বাজার তো বটেই, বিদেশেও রপ্তানিযোগ্য পণ্য সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অরুণ পাল বলেন, “আমরা গ্লেজ ফায়ারিং করতে পারলে এতে পণ্যের গুণমান অনেক বাড়ত এবং সহজেই বিদেশে রপ্তানি করতে পারতাম। কিন্তু গ্যাস না থাকায় সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছি না। অথচ আমাদের এখানে মাটির পণ্যের আন্তর্জাতিক চাহিদা রয়েছে। প্রশাসনের কাছে আমাদের আবেদন, দ্রুত যেন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়।”
এদিকে, এই শিল্পের ইতিহাসও সমৃদ্ধ। ১৯৬১ সালে ‘প্রগতি সংঘ’ নামে ১৫ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। প্রতিজন মাত্র এক টাকায় একটি শেয়ার কিনে এবং ৫০ পয়সা আমানত রেখে শুরু করে এই উদ্যোগ। পরে সমবায় আন্দোলনের পথিকৃত ড. আখতার হামিদ খানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠার নতুন নাম হয় বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি। মাত্র ২২ টাকা ৫০ পয়সা মূলধনে শুরু হওয়া এই সমিতির বর্তমান সম্পদের পরিমাণ প্রায় সাত কোটি টাকা। সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫০ জনে।
১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলেও ১৯৭২ সালে তৎকালীন সরকার ৭৫ হাজার টাকা প্রণোদনা দিয়ে এ শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করেন। কিন্তু বর্তমানে গ্যাস সংকট যেন আবার সেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্পকে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার উত্তর বিজয়পুর, দক্ষিণ বিজয়পুর, তেগুরিয়াপাড়া, গাংকুল, বারোপাড়া, দুর্গাপুর ও নোয়াপাড়া গ্রামের শত শত পাল ও কুমোর সম্প্রদায়ের মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এক সময় প্রায় আটশতাধিক পরিবার মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে শতাধিক পরিবারে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কোনো কক্ষে চলছে মাটির মূর্তি তৈরির কাজ, অন্য কক্ষে চলছে ছাঁচ তৈরির প্রক্রিয়া। নারী-পুরুষ সবাই ব্যস্ত শিল্পপণ্য তৈরি নিয়ে। নারী শ্রমিক পার্বতী রানী পাল বলেন, “পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। বারো হাজার টাকা বেতন পাই। এখন গ্যাস না থাকায় খরচ বেশী হচ্ছে। তাই সমিতি আমাদের ঠিকমতো বেতন দিতেও হিমশিম খাচ্ছে।”
এদিকে বিষয়টি নিয়ে মতামত দিয়েছেন ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবির। তিনি বলেন, “মৃৎশিল্প শুধু একটি পেশাগত কার্যক্রম নয়, এটি আমাদের লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। বিজয়পুরের মৃৎশিল্পকে বাঁচাতে হলে সরকারকে দ্রুত গ্যাস সংযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের আধুনিকীকরণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যথায় এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “একটি শিল্প টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা, টেকসই অবকাঠামো এবং সরকারের আন্তরিকতা। বিজয়পুরের মৃৎশিল্প তার সবগুলো ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। এখনই পদক্ষেপ না নিলে কয়েক বছরের মধ্যেই এই শিল্প চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।”
এদিকে, গ্যাস–সংকট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (কোম্পানি সচিব) মো. এনামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘সেখানে গ্যাস–সংযোগ থাকলেও আমাদের গ্রাহক বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানে পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। এরপরও তাঁরা বাখরাবাদে এসে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারেন। আমরাও দেখছি, কী করা যায়।’
এ বিষয়ে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়া খানমের কাছে (বদলী হওয়ার পূর্বে) জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। কেননা আমরাও চাই মৃৎশিল্প পণ্যে কোয়ালিটি বাড়ুক।”
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় এরই মধ্যে কুমিল্লার রসমালাই ও খাদি জিআই পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিজয়পুরের মৃৎশিল্প জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি।’
মৃৎশিল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি, গ্যাস সংযোগ নিশ্চিত না হলে বিজয়পুরের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প হয়তো আর টিকে থাকবে না। প্রশাসনের বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ ছাড়া এই শিল্পের ভবিষ্যৎ এখন কার্যত অনিশ্চিত।
ইখা